ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে কারা থাকছেন ?

ডেস্ক রিপোর্ট – ছাত্রলীগের নতুন কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ পেতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছেন এক ঝাঁক বসন্তের কোকিল। এর মধ্যে মাদক ব্যবসায় জড়িত, হত্যা মামলার আসামি, অস্ত্র মামলার আসামি, নারী নির্যাতনকারী, অছাত্র ও বিবাহিতরা আছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই মৌসুমি নেতাদের আকষ্মিক অতি-সক্রিয়তায় আগের পোড় খাওয়া ছাত্রনেতারা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে ভিড়তেই পারছেন না। আঞ্চলিক পরিচয় দিয়ে সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে সর্বত্র ঘিরে রাখে একটি সিন্ডিকেট। এর ফলে মাঠের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের সাথেও দূরত্ব বাড়ছে সংগঠনের শীর্ষ নেতৃত্বের। সম্প্রতি ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মসূচিতেও এই দূরত্ব দেখা গেছে।

চলতি বছর ৩১ আগস্ট রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করা হয় সংগঠনটির শীর্ষ দুই পদ। এরপর থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজনেই ‘অতি শীঘ্রই’ কেন্দ্রীয় কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথা বলে আসছেন।

এমনকি সংগঠনটির অন্যতম অভিভাবক হিসেবে খ্যাত সেতুমন্ত্রী ও আওয়ামী সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ‘জানুয়ারিতে কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে’ বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তা এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি।

বর্তমান শীর্ষ নেতৃত্ব ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রভাবশালী নেতাদের তৈরি ‘সিন্ডিকেটের’ বাইরে হয়েছিলো-এমনটাই শোনা যায়। তাই সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ছিলেন নিশ্চিন্ত। অনেকে ভেবেছিলেন এবারে আর পদ পেতে ‘লবিং’ করতে হবে না। তাদের যোগ্যতার মাপকাঠিতেই পদ পাবেন তারা। তবে বর্তমানে আর এমনটি ভাবছেন না বলেই জানান পদপপ্র্যাশী বিভিন্ন নেতাকর্মী।

কারণ হিসেবে তারা জানান, আসলে সিন্ডিকেট আগের জায়গাতেই আছে। শুধু হাত বদল হয়েছে। তাই কর্মীদের ভাগ্য সেই আগের বারের মত লবিং ও নেতাদের আজ্ঞাবহ থাকার উপরই নির্ভর করবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আগের কমিটির এক সম্পাদক জানান, সিন্ডিকেটের বাইরে আসলে কিছুই হবে না। ভাইয়ের পেছনে না ছুটতে পারলে কোন পোস্ট আসবে না। আর ‘ভাই’দের কাছে সবার আগে প্রাধান্য তাদের এলাকার। আমাদের ভরসার জায়গা জননেত্রী শেখ হাসিনা। তিনি যদি সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন তবেই যোগ্যদের মূল্যায়ন হবে।

ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্রের ১১(ক) ধারা অনুযায়ী সংগঠনটিতে সহ-সভাপতি ৪১জন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ১০ জন, সাংগঠনিক সম্পাদক ১০ জনসহ মোট ২৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বয়স সর্বোচ্চ ২৯ বছর ও তাদের অবিবাহিত হতে হবে। সেই অনুযায়ী বিগত কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন এমন অনেক নেতাকর্মীদের বর্তমান কমিটিতে পদ পাওয়ার সুযোগ নেই।

কারণ অনেক নেতাই বর্তমানে বয়স ২৯ এর বেশি ও বিবাহিত। তাদের মধ্যে উলে¬খযোগ্য হলেন, উপ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক আরিফ খান লাভলু, সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান সুমন, সহ-সভাপতি মো. আল আমিন, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক তানজীল ভুঁইয়া তানভীর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহিদুল ইসলাম শাহেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল হাসান ফারুক, সহ-সভাপতি সৈয়দ আশিক, কর্মী ইমরোজ হায়দার, সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আল আমিন মন্ডল, সাংগঠনিক আশিকুল পাঠান সেতু, সহ-সম্পাদক এনামুল হক প্রিন্স। যদিও এদের মধ্য অনেকে বিয়ের কথা গোপন করে পুনরায় পদ পাওয়ার জন্য তদবির চালাচ্ছেন।

তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- বিগত কমিটির ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক খায়ের উদ্দিন ও সহ-সভাপতি শামসুন্নাহার হলের সাবেক নেত্রী নিশিতা ইকবাল নদী। তারা দুজনেই বিয়ে গোপন করে পুনরায় পদ পেতে বেশ জোর তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে, ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বললে তারা এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করেন যে, এবারেও পদপ্রত্যাশীদের তালিকায় আছে হত্যা মামলার আসামি, মাদক ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, প্রশ্ন ফাঁসকারী, অপহরণকারী ও প্রকাশ্য নারী নির্যাতনকারী অনেকে। আছে শিবির ও ছাত্রদলের কর্মীরাও। এদের মধ্যে বর্তমানে অনেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বেও আছেন।

এদের মধ্যে সাবেক ছাত্রদল নেতা হিসেবে অভিযুক্ত হলেন উপ-অ্যাপ্যায়ন সম্পাদক মোরশেদুল হাসান রুপম, উপ কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক সাদ বিন কাদের। শিবির সংশি¬ষ্টতার অভিযোগ আছে আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ সম্পাদক হাফেজ তাজ উদ্দিনের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন সময় অনেকেই তাদের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য হয়েছেন গণমাধ্যমের শিরোনাম।

এদের মধ্যে হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান সানী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের সাধারণ সম্পাদক আল আমিন রহমানের বিরুদ্ধে সরাসরি গত বছরের জানুয়ারিতে সাত কলেজের অধিভূক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত দুই নারী শিক্ষার্থীকে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এদের দুজনেই জড়িত ছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর মারধরে। আল আমিন একসময় জড়িত ছিলেন জাসদ ছাত্রলীগের সাথে। তার পদবী ছিলো গবেষণা ও প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক। মাদক ব্যবসায়ের যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে গত কমিটির সহ-সভাপতি আরেফিন সিদ্দিক সুজন ও সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান সেতুর বিরুদ্ধে।

আরও অভিযোগ রয়েছে যে, ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক শাহরিয়ার মাহমুদ রাজু, কবি জসীম উদদীন হল ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রমজান হোসাইন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিজে হার্ট হলের (আন্তর্জাতিক হল) মালি সুমন লালকে মাদক গ্রহণকালে আটক করে পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এর মধ্যে সুমনকে এর আগেও মাদকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হল থেকে আটক করা হয়েছিল। আটক দুই ছাত্রলীগ নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে ওই কক্ষটি সিলগালা করে দেয় হল প্রশাসন।

ছাত্রলীগের নেতাদের একাংশের অভিযোগ, গত বছর সূর্যসেন হলের ৩১৫ নম্বর রুম, যেখানে আরেফিন সিদ্দীক সুজন থাকতেন, সেখান থেকে বিপুল পরিমান দেশীয় ও আগ্নোয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। সেসময় সেখানে পাওয়া যায় ইয়াবার প্যাকেটও। এছাড়া রাজধানীর নীলক্ষেতে প্রকাশ্য অস্ত্র মহড়া দিয়ে আটক হয়েছিলেন সাংগঠনিক সম্পাদক তানজীল ভূইঁয়া তানভীর ।

গত সম্মেলনের আগেই তানভীরের বয়স ২৯ পেরিয়ে কয়েক মাস অতিরিক্ত হয়েছি। এবার তিনি পদ পেতে হাজিরা দিচ্ছেন সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কাছে। এ ছাড়া সাবেক নেতা সৈয়দ আরাফাতের বিরুদ্ধে ২ লাখ টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে। আরেক সাবেক নেতা নোবেল চকবাজারে প্ল্যস্টিক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবি করে বিতর্কিত হয়েছেন কয়েকবার। ইন্দ্রজিৎ সারমা রনি ও সাদিক খান বিবাহিত।

নীলক্ষেতে ইন্টারনেট ব্যাবসায়ী তুহিনের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতে গিয়ে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে চারুকলার সাগর হোসেনের সোহাগের বিরুদ্ধে। অপরদিকে আতিকুর রহমান আতিক নিজে মাদকাসক্ত। চাঁদাবাজি ও অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক ছাত্র নেতারা বলছেন, এমন ছাত্র নেতারা পার্টির নেতৃত্বে আসলে সাবেক ছাত্রলীগ পরিচয় দেওয়াই কঠিন হয়ে যাবে।